জিয়াউল হক আকন্দ, বাবার নাম হামিদুল হক আকন্দ , মায়ের নাম কাজী সালেহা বেগম। নেত্রকোনা সদর উপজেলার নারান্দিয়া গ্রামের শান্ত ও বোকা স্বভাবের একটি ছেলে । তার সহপাঠী আর স্কুল বন্ধুরা যখন দুরন্তপনা আর দুষ্টুমি নিয়ে থাকে, তখন সে চুপচাপ একা একা গ্রামের কোথাও বসে থাকত । বাড়ির পেছনে কাঁঠাল গাছের গর্তে কিভাবে কাঠবিড়ালিরা আসা যাওয়া করত একমনে সে তা দেখত অথবা ঘন্টার পর ঘণ্টা মনযোগ দিয়ে তাদের হুলো বেড়াল টার সাথে পাশের বাড়ির মেওটার আলাপচারিতা শুনত । বাড়ির কামলা ছেলের সাথে সাদা গাভীটাকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনমান পার করত সে । কাজী বংশের প্রতাপ আর তেজস্বী যেমন ছিলনা তেমনি ভাবে আকন্দ বংশের ধর্ম পরায়ণাতার কোন বালাই ও তার মধ্যে ছিলনা । তাকে নিয়ে মা বাবার আফসোস এর অন্ত ছিলনা । তার অন্য ভাইয়েরা পড়াশোনায় ভাল ছিল , তেমনি তাদের গায়ের জোরও কম ছিলনা । তার ভাইয়েরা গাঁয়ের অন্যান্য ছেলেদের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে উস্তাদ ছিল ।তার বাবা তখন ছেলেদের পিঠ চাপড়ে বলতেন “ সাবাস, বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া” ।
জিয়াউল তার ভাইদের অথবা বন্ধুদের সাথে স্কুলে যাওয়া পছন্দ করতনা । সে একা একা গাঁয়ের পথ ধরে অর্থাৎ বড় রাস্তা ছেড়ে বিকল্প পথে ৫ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করত । কখনো বনের পাশ দিয়ে , কখনোবা ফসল ভরা মাঠের সরু আইল দিয়ে । যে সমস্ত ছেলেদের গায়ে তার গুণধর ভাইয়েরা হাত তুলত তারা প্রতিশোধ এর ঝালটা মেটাত জিয়াউল এর উপর দিয়ে । একা পেয়ে তার খাতা পেন্সিল কেড়ে নিত , অথবা তার স্কুল ড্রেস ময়লা করে দিত । চড় , থাপড় দিতেও ইতস্ততা করতনা , কিন্তু এ ব্যাপারে জিয়াউল কোনদিন কারো কাছে মুখ খুলেনি । মা জিজ্ঞেস করে বলে দিত , হোঁচট খেয়ে কাদায় পড়ে গিয়েছিলাম, অথবা লেবু কাঁটায় লেগে শার্ট ছিঁড়ে গেছে । সে আনমনে দীঘির জলে বরশী নিয়ে বসে থাকত ।মাছ সে পেত কদাচিৎ। কারণ বরশির ফাতনার দিকে তার চোখ থাকত না । তার দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরত ।পানির তলার বুদবুদ, খলসে মাছের ঘরবুননশৈলী , টাকি মাছের হাজারো বাচ্চা নিয়ে খাবার খোঁজার দৃশ্য কিছুই তার দৃষ্টি এড়াতনা । প্রকৃতির হাজারো রহস্য ঘেরা সৌন্দর্য তাকে গিলে খেত সবসময় । আবারো বলছি , জিয়াউল আসলেই সময়ের কোন বিস্ময় বালক নয় । বলার মত শ্রেনী ফলাফলও তার ছিলনা ।গ্রামের হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণিতে যার রোল নম্বর ছিল -৬৩ , আর যে ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা ছিল সব মিলিয়ে ৬৮ ।
যাক এবার মূল কথায় আসি । জিয়াউলদের বাড়ির পূর্বপাশে একটি পুরোন হিন্দু বাড়ি ছিল । দেশ বিভাজনের সময় একটা হিন্দু পরিবার বাড়িটিকে সেই যে ছেড়ে গিয়েছিল আর ফেরেনি । ভাঙ্গা পাঁচিলে ঘেরা এই রহস্যময় বাড়ি টিতে দিনের বেলাতেও অকারনে কেউ যেতনা ।গল্প আছে এই বাড়িটিতে অসংখ্য সাপের বাস ছিল । আর দৃশ্যমান যেটি ,সেটি হল এই বাড়ির ভেতর ছিল শত শত উই পোকার ঢিবি । একটি সিজনে গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই এই উই পোকার উপদ্রব দেখা যেত । গোধুলীর সাথে সাথেই ছোট বড় হাজারো উইপোকা ওই বাড়ি থেকেই উড়ে আসত অথবা মাটির নীচ দিয়ে আক্রমন চালাত। এবং প্রায় তিন ঘন্টা গ্রামের ঘরবাড়ি দখল করে তান্ডব চালাত । জিয়াউল এর মা উই পোকা তাড়ানোর জন্য বাড়ির উঠোনে বড় করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করেতেন । আর শত শত পোকা সেখানে আত্মাহুতি দিত । এই দৃশ্যটি জিয়াউল এর ভাল লাগতনা ।সুন্দর সুন্দর পোকাগুলির এই প্রয়ানে তার বালক মন কেঁদে উঠত ।সে ভাল করে চিন্তা করত, উই পোকা তো কখনো মানুষের কোন ক্ষতি করতে আসেনা । কিছুক্ষণ থেকে তার পর চলে যায় ।বালকেরা যেমন ক্রিকেট খেলে , হয়ত এটাও তাদের তেমনি একটি খেলা । তাহলে মানুষ কেন তাদের প্রতি এত নির্মম হবে ?আচ্ছা , মানুষকে যদি এমনভাবে উই পোকারা মারত, তাহলে ? তাই মায়ের আড়াল হলেই জিয়াউল কল থেকে বদনা দিয়ে জল ভরে চুপচাপ সেই আগুনে ঢেলে দিত । শুধু তাই নয় বৃষ্টি এলে জিয়াউল কলা গাছের পাতা দিয়ে উই বাড়ির সবকটা উইয়ের ঢিবি ঢেকে দেবার ব্যবস্থা করত, যাতে ভেতরে জল না যায় ।
এই পরিত্যক্ত বাড়ির সাথে জিয়াউল এর ছিল হৃদয়ের সম্পর্ক । সে সবার চক্ষু এড়িয়ে নিরিবিলি এই বাড়িতে চলে আসত ।এই বাড়ির পুকুরঘাট , বড় বড় নানা রকম গাছের সাথে তার একধরনের সখ্যতা গড়ে উঠে । তবে সবচেয়ে মিতালী যাদের সাথে হয় তারা হল এই বাড়ির হাজার হাজার উইপোকা । সে খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করত, এরা তাকে কখনো কামড়াতে আসছেনা । আপন মনে সারাক্ষণ কাজ করছে ।তবে সে এই বাড়িতে কোন সাপের দেখা পায়নি এমনকি একটা মশাও চোখে পড়েনি । মানুষ কেন বাড়িটিকে এত ভয় পেত, তা সে বুঝে উঠতে পারত না। আচ্ছা , মানুষ কি ভয় পেতে ভালবাসে । হলেও হতে পারে। জিয়াউল আশ্চর্য হতো যখন শুনত প্রতি ১ ঘন্টা পর পর উইপোকার ঢিবির নীচ থেকে একটা তীব্র সাইরেন এর মত আওয়াজ আসছে।আর সাথে সাথে অন্যান্য সকল শব্দ বন্ধ হয়ে যেত এমন কি একটা পাখিও রা’ করতনা । প্রথম প্রথম ভূতের কাণ্ড মনে করে দৌড় দিয়েছিল জিয়াউল। কিন্তু এখন গা সওয়া হয়ে গেছে । জিয়াউল এর মা বাবা ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু সে বাড়িতে তার যাওয়া আসা বন্ধ করতে পারেন নি ।গোপনে তার উপর কবিরাজী চিকিৎসাও চলে । কিন্তু অবশেষে কবিরাজকূল ব্যর্থ হয়ে তার মাবাবাকে কে “আল্লাহ আল্লাহ” করতে পরামর্শ দেন । বাবা মা ভাবেন বড় হলে বোধ হয় অথবা জিয়াউল পড়াশোনা করতে অন্যত্র চলে গেলে এ বাড়ির আছরও একদিন কেটে যাবে ।কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি ।
দিন গড়িয়ে যায় । সামনে জিয়াউল এর এস এস সি পরীক্ষা । গনিত , রসায়ন ,পদার্থ , জীব ছাইপাশ কিছুই মাথায় ঢোকেনা । পরীক্ষাতে নিশ্চিত ফেল করার মত প্রস্তুতি তার । মাকে সালাম করতে যায় সে । তার মা সালেহা বেগম জানেন ছেলের অবস্থা কি ? আর এও জানেন ফেল মারলে তার বাবা তার সাথে কি ব্যবহার করবেন ।তিনি শুধু অস্ফুটে বলেন “ হে আল্লাহ, তুমি আমার সহজ সরল ছেলেটাকে একটু দেখ ।
জিয়াউল ভাবে , পরীক্ষার রেসাল্ট দেবার আগে পর্যন্তই তার আয়ু , হয় সে আত্মহত্যা করবে না হয় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে । বাবার গঞ্জনা সে সইতে পারবেনা ।কিন্তু তার জীবনে সেদিন ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা , যার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পরবর্তীতে তার অনেক কস্ট হয়েছিল ।
সেদিন ছিল তার ম্যাথ পরীক্ষা । পরীক্ষা শুরু হল ১০ টায় । সে প্রশ্ন টি নেড়েচেড়ে দেখল । সমগ্র প্রশ্ন থেকে একটিও সে পারেনা কিংবা পারার কথাও নয় । ১ ঘন্টা পর খাতা দিয়ে চলে যাবে ভাবছে ।তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে । কেন সে এমন , কেন তার পড়তে ইচ্ছে করেনা , তার এমনি হাজারো আত্ম জিজ্ঞাসার কোন জবাব সে পায়না । ঘড়িতে ঠিক বেলা ১১টা । অদ্ভুত কাণ্ডটা তখনই ঘটল যার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা । হুট করেই সে তার কানের কাছে সাইরেনের মত তীব্র আওয়াজ শুনতে পেল । কিন্তু ঝাপসা চোখে সে দেখতে পেল সে ছাড়া আর কোন পরীক্ষারথীর নড়াচড়ার কোন পরিবর্তন হয়নি ।গনিত প্রশ্নটা তার হাতেই ধরা ছিল। নিমেষেই সে দেখতে পেল আজকের প্রশ্নপত্রের সবকটা অঙ্কই তার কমন পড়েছে। মনে হচ্ছে এগুলো তার হাজার বার কষা অংক । অথচ সে জানে ,বকা খাবে বা অপদস্থ হবে বলে সে লজ্জায় অঙ্ক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তেও কোনদিন যায়নি । সে আনসার দেয়া শুরু করে । অদ্ভুত ভাবে সে দেখল মাত্র ৪০ মিনিটে সে সকল অঙ্কের শুদ্ধ উত্তর দিয়ে ফেলেছে ।১০.২৫ মিনিটে সে উত্তর দিয়ে বেরিয়ে আসে । বাড়িতে গিয়ে সে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে, তার কান্না আর থামতে চায়না ।প্রকৃত কারণ না বুঝলেও তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন ।
সেবার এস এস সি পরীক্ষায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে জিয়াউল । বাবা যখন তাকে প্রথম বারের মত জড়িয়ে ধরে মুখে মিস্টি তুলে দিলেন তখন আবারো কাঁদল জিয়াউল ।তৃতীয়বারের মত সে আবার কাঁদল সেই ভাঙাবাড়িতে গিয়ে । যদিও জীবনে চতুর্থ বারের মত ারেকবার কাঁদতে হয়েছিল জিয়াউল কে । সে ঘটনাই এখন বলে শেষ করছি এই গল্পখানা ।
সাফলে্যর ধারা অব্যাহত ছিল জিয়াউলের । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান-রসায়ন বিভাগে চান্স পায় সে । সে বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে একদিন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসাবে চাকরীও পায় সে ।তবে শিক্ষা আর চাকরী জীবনে কখনই সেই বাড়ির কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভূলেনি জিয়াউল । জীবনে সে যতবার নিজের বাড়ি যায় ততবার সে আগে যেত সেই পোড়াবাড়িতে । আর ১৯৯৯ সালে তার বাবাকে বলে সেই ভাঙা বাড়ীর পুরোটা জুড়ে একটি টিনের ছাউনি তুলে দেয় ।ছেলের সফলতায় হামিদুল সাহেব এতটাই খুশী ছিলেন ছেলের এই পাগলামি টাকে তিনি আনন্দের সাথে প্রশ্রয় দিলেন ।
২০১২ সালের ২২ শে অক্টোবর, রাত ১১.৪৫ পি.এম । জিয়াউল ঢাকায় তার সরকারী বাসবভনে বসে , ফেস বুকে কানাডিয়ান এক বন্ধুর সাথে চ্যাটিং করছিলো ।হঠাত সে দেখলো তার আই ডি তে একটি এর বার্তা এসেছে । কিন্তু তা তার মেসেজ নোটিফিকেশন আইকনে শো না করে সরাসরি স্ট্যাটাস বার সহ পুরা পেজ জুড়ে -এ বার বার ব্লিঙ্কিং করছে । কিন্তু সে আরো আশ্চর্য হলো যখন লক্ষ্য করল এটা কোন আই ডি কিংবা কোন মেইল থেকে আসেনি , যা ফেস বুকে সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। আর সে পড়া শেষ করার সাথে সাথে তা আর খুঁজে পাওয়া গেলনা।
বার্তাটি ছিল এরকম -
“ This message is to confirm your Identity from us . We considered you as our friend.
Our mission have been accomplished and just wandering for another planet.
Good wishes for you and your Earth.
Thanks anyway for the co-operation.”
যা বোঝার সে বুঝে ফেলল ।জিয়াউল এক মুহূর্তও দেরী করলনা । এটা ছিল ঈদের সিজন ।সারারাত যাত্রী পারাপার । ট্রাউজার পরেই সে রওনা হল ।
সি এন জি , বাস আর রিক্সা সব পেরিয়ে সে যখন পোড়াবাড়িতে পৌঁছল তখনো ভোর হবার মাত্র ১৫ মিনিট বাকী । না , তার প্রিয় বাড়িতে তার জন্য আর কোন মেসেজ নেই , ৬০ মিনিটের মাথায় সেই সাইরেনের মত আওয়াজ টাও আর পেলনা । কেবল পূর্বাকাশ জুড়ে রয়েছে একটি অপার্থিব গোলাপী আভা । ওই পথেই গেছে জিয়াউলের বন্ধুরা ।
ভোরের আলো তখনো ঠিকমত ফোটেনি । জিয়াউল তার মোবাইল ফোনের টর্চটী জ্বালল । তার অনুমান একদম ঠিক ।সারাবাড়ি জুড়ে উইপোকার একটা ঢিবির অস্তিত্বও আর নাই। তারা চলে গেছে ।¬জিয়াউল আবারো কাঁদল ।
আনন্দে , শোকে । অস্ফুটে বলল , “ভাল থাক আমার বন্ধুরা, সফল হোক তোমাদের মিশন ” ।
......।।
০৩ সেপ্টেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪